ভালো জমি চেনা
বাড়ি বানানোর পরিকল্পনায় আপনার প্রথম ধাপ হবে উপযুক্ত জমি বেছে নেয়া। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আর সিদ্ধান্তটি নেবার আগে আপনার অবশ্যই কয়েকটি জরুরি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। বিষয়গুলো হচ্ছে:
- আপনার জমিটি খুব উঁচু জায়গায় হলে বাড়ির ফাউন্ডেশন তৈরি করতে অতিরিক্ত খরচ, পরিশ্রম ও সময় লাগতে পারে।
- আপনার জমি খুব নিচু জায়গায় হলে সুয়্যারেজের সমস্যা আর পানিবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।
- আপনার জমির মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি হলে ফাউন্ডেশন মজবুত হবে না।
- আপনার জমিটি উঅচ-এর অন্তর্ভুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করুন।
নিজের ও প্রিয়জনদের জন্য একটি সুন্দর বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন কে বাস্তব করার জন্য চাই পূর্ব-পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতির একটা বড় অংশ হচ্ছে বাড়ি নির্মাণের জন্য কী কী করতে হয় তা আগে থেকে জেনে নেয়া। আপনার বাড়ি নির্মাণের কাজগুলো আরেকটু সহজ করে দেবার জন্যই কেএসআরএম-এর এই উদ্যোগ। বাড়ি নির্মাণের জন্য শুষ্ক, সমতল জমি সবচেয়ে উপযোগী। বিভিন্ন ধরনের জমির বৈশিষ্ট্য জেনে নেবার জন্য অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিন।
জমির এলাকার ব্যাপারে জেনে নেয়া
এছাড়াও যে এলাকাতে আপনার বাড়িটি হবে সে এলাকার ব্যাপারে আপনার কিছু তথ্য
জেনে নেয়া জরুরি:
- যে এলাকায় জমিটি কিনছেন সে এলাকাটি কি আপনার অফিস আর আপনার সন্তানের স্কুল/কলেজের কাছাকাছি?
- যে এলাকায় জমি কিনছেন সেখানে কি আপনার প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো (যেমন বাজার / ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, হাসপাতাল/ক্লিনিক) পাওয়া যাবে?
- যে এলাকায় জমি কিনছেন সেখানে কি উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে?
জমি কেনা
জমি নির্বাচন করার পর আপনার জমির বর্তমান মালিকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আইনগতভাবে জমি হস্তান্তর করার জন্য:
- বিক্রেতাকে বলুন বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে মিউটেশন ফর্ম সংগ্রহ করে তা সঠিকভাবে পূরণ করে জমা দিতে। ফর্মটি ভূমি মন্ত্রণালয় অফিস বা তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে (http://www.minland.gov.bd)
- জমিটির হালনাগাদ ভূমিকর দেয়া আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
- বিক্রেতার কাছে জমিটির ভায়া দলিল আছে কিনা প্রশ্ন করুন। থাকলে তা ভালোভাবে পড়ে দেখুন এবং একজন ভালো উকিলকে দলিলগুলো দেখিয়ে তার পরামর্শ নিন।
- বাংলাদেশ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে জমির তফসিল অনুযায়ী বিক্রেতা স্বাক্ষর করে জমি আপনার নামে হস্তান্তর করে দিবেন। আপনার স্বাক্ষর করে জমির মালিকানা নিয়ে নিন।
- আপনাকে জমির দলিল ও খতিয়ান দেয়া হবে। যদি জমিটির মালিকানা সরকারের কাছে থাকে, তাহলে তা পুরোপুরি কিনে নেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারি জমি ৯৯ বছর পর্যন্ত ইজারা বা লিজ নেয়া যায়। সেই লিজের জন্য আপনার সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে অরিজিনাল অ্যালটমেন্ট লেটার সংগ্রহ করতে হবে।
বাড়ি নির্মাণ
এবার আপনার বাড়ি নির্মাণের পালা। আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়াররা বাড়ি নির্মাণের ব্যাপারে আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অভিজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করবেন। আপনার সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুমোদন আর দলিলপত্র সংগ্রহ করতে হবে, যেগুলোর বিবরণ নিচে দেয়া আছে। উলেখ্য যে, আপনি ঢাকার বাইরে অবস্থিত হলে রাজউক-এর বদলে আপনার সিটি করপোরেশনের বা পৌরসভার কাছ থেকে দলিলগুলো নিতে হবে। বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে আপনার যে কাজগুলো করতে হবে তা হচ্ছে:
প্রথমে কোনো অভিজ্ঞ ভূমি জরিপ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আপনার জমি জরিপ করিয়ে নিন। নিখুঁত জরিপের জন্য এখন ডিজিটাল জরিপ ব্যবস্থাও পাবেন।
আপনার জমির মাটির ধরনের ওপর আপনার বাড়ি নির্মাণের প্যান নির্ভর করবে, তাই সয়েল টেস্ট প্রথমেই করিয়ে নেয়া ভালো
রাজউক-এর সাথে রেজিস্টার করা কোনো আর্কিটেক্ট বা আর্কিটেকচার ফার্মের কাছে আপনার জমির দলিলপত্র আর ভূমি জরিপের তথ্য জমা দিতে হবে
আর্কিটেক্ট আপনাকে একটি হাউজ প্যান / বু প্রিন্ট দেবেন রাজউক অফিস থেকে এই প্যানের অনুমোদন নিয়ে আসতে হবে। আপনার হয়ে আর্কিটেক্টও এই কাজটি করতে পারেন
প্যান পাশ হয়ে যাবার পর আপনার বাড়ি নির্মাণকাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে। এ পর্যায়ে এসে:
- একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলুন
- স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার আর্কিটেক্টের প্যান অনুসরণ করে আপনার বাড়ির স্ট্রাকচার ডিজাইন দেবেন সে ডিজাইন অনুযায়ী আপনার বাড়ির কাজ শুরু হবে
বাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো
বাড়ি নির্মাণের জন্য আপনার রড, সিমেন্ট, বালু, ইট-জাতীয় নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োজন হবে। আরো প্রয়োজন হবে কনট্র্যাকটর আর শ্রমিকের। শ্রমিক আর নির্মাণ সামগ্রীর ব্যাপারে আপনার ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে অবশ্যই পরামর্শ নিন। যেকোনো প্রয়োজনে ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না। আজকাল বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো সবধরনের নির্মাণ সেবাই দিয়ে থাকে।ইঞ্জিনিয়ার আর আর্কিটেক্টরা বাড়ি নির্মাণের ব্যাপারে আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু আর পরামর্শক হিসেবে কাজ করবেন। রড আপনার বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে রডের কাঠামোর ওপর, তাই ভালো রড বেছে নিতে ভুলবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, যে রড কিনছেন সেটা যে ভালো তা বুঝবেন কী করে? ভালো রডের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যেগুলো সাধারণ রডে থাকে না। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে:
টেকসই আর মজবুত: রডে ইল্ড স্ট্রেংথ (Yield Strength) নামে একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। এটা হচ্ছে রডের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা। যে রডে ইল্ড স্ট্রেংথ যতো বেশি, সে রড বাড়ি নির্মাণের জন্য ততো ভালো। বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে ভালো রডে ৫০০ এমপিএ (৭২৫০০ পিএসআই) ইল্ড স্ট্রেংথ থাকে। ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাড়িকে রক্ষা করার ব্যাপারেও রড সাহায্য করে। যে রড কিনছেন সেটা আর্থকোয়েক রেজিস্ট্যান্ট কিনা তা আগে থেকে জেনে নেয়া ভালো।ভালো ঝালাই উপযোগিতা: সাধারণ রডে ঝালাই করার সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এদের মধ্যে একটা হচ্ছে এমব্রিট্ল টেন্ডেন্সি, বা রড ভঙ্গুর হয়ে যাবার প্রবণতা। সাধারণ রড ঝালাই এর পর ঠান্ডা হবার সময় বেঁকেও যেতে পারে। এতে নির্মাণকাজে অসুবিধা হয়। রড কেনার সময় অবশ্যই এমন রড বেছে নিন যেটাতে এই সমস্যাগুলো নেই। এমন রড বেছে নিন যেটাতে কার্বন কনটেন্ট কম আছে। এ ধরনের রড সহজে বাট-ওয়েল্ড বা ল্যাপ-ওয়েল্ড করা যায়, যাতে আপনার নির্মাণে সময় বাঁচবে। ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা: ভালো রড থার্মো-মেকানিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্রসেস-এ তৈরি করা হয়। এ কারণে রডে ক্ষতিকারক টরসোনাল রেসিডিউয়াল স্ট্রেস (Torsional Residual Stress) থাকে না। এ ধরনের রডে ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে।
ডাক্টিলিটি: আপনার বাড়ি নির্মাণে যে কংক্রিট ব্যবহার হবে সেটাকে দীর্ঘ দিন মজবুত রাখার জন্য আপনার ডাক্টাইল রড প্রয়োজন। ভালো, ডাক্টাইল রড কংক্রিটে ফাটল ধরতে দেয় না। আধুনিক কোয়েনচিং অ্যান্ড ট্যাম্পারিং প্রসেস অনুসারে তৈরি করা রডে ডাক্টিলিটি বেশি থাকে। রড কেনার সময় আপনি এটাও জেনে নিতে পারেন যে রডের কার্বন কনটেন্ট কতখানি, কারণ কম কার্বন কনটেন্ট-এর রড বেশি ডাক্টাইল হয়।
ধারাবাহিকতা: আপনি একবারে অনেকগুলো রড কিনবেন। তাই এসময় খেয়াল রাখা উচিত যে সবগুলো রডই সমমানের কিনা। ভালো রড উৎপাদনের সময় প্রতিবার কোয়েনচিং অ্যান্ড টেম্পারিং (ছ্ঞ – ছঁবহপযরহম ধহফ ঞধসঢ়বৎরহম) প্রসেস একইভাবে অনুসরণ করা হয়। রডের উপাদানেও পরিবর্তন হয় না। ভালো রডেসম্পূর্ণ সোজা: কনস্ট্রাকশন সাইটে রড সোজা করা বেশ সময়সাপেক্ষ আর পরিশ্রমের কাজ। তাই কেনার সময়ই আপনার খেয়াল রাখা উচিত রড সম্পূর্ণ সোজা আছে কিনা। সাশ্রয়: আপনার বেছে নেয়া রডে যদি ইল্ড স্ট্রেংথ, ডাক্টিলিটি আর ঝালাই ক্ষমতা বেশি থাকে, তাহলে নির্মাণের সময় আপনার খরচ কমে আসবে। শ্রমিকদের সময় বাঁচবে আর পরিশ্রম কম করতে হবে। বালি বালিকণার আকার ৫ মিলিমিটারের কম আছে কি না তা দেখে নিন। বাড়ি তৈরির এ উপাদানটির জন্য নদীতীরের বালি সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস। তবে বালিতে কোনো ধরনের ধুলো, কাদা, চিড় ও জৈব অপদ্রব্য থাকলে হবে না। আর বালির গুণমান আপনি নিজেই খুব সহজে যাচাই করে নিতে পারবেন
হাতের মুঠিতে সামান্য বালি নিয়ে কিছুক্ষণ ঘষে ফেলে দিন। মুঠ খুলে দেখুন। ভালো মানের বালি হাতের তালুতে আটকে থাকবে না
একটি কাচের জগ বা মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতলে সামান্য বালি নিয়ে তাতে এর দ্বিগুণ পরিমাণ পানি ঢালুন। জগ বা বোতলের মুখ বন্ধ করে সেটিকে ভালোভাবে ঝাঁকান। এরপর এক ঘণ্টা রেখে দিন। বালির মান অনুযায়ী সেখানে আলাদা আলাদা স্তর তৈরি হবে, যা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
সুরকি- পাথরচূর্ণ ও কাঁকর/নুড়িপাথর কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণের স্থূল উপকরণ বা সুরকি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর আকার ৪০, ২০ বা ১০ মিলিমিটার হয়ে থাকে। বাড়ির স্ল্যাব ,
বিম ও কলাম তৈরিতে ২০ মিলিমিটার ও ১০ মিলিমিটারের উপকরণই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। সুরকি শক্ত, দৃঢ় ও টেকসই হতে হবে। পাশাপাশি কাদা, মাটি, লতাপাতা, শ্যাওলা ও
বাইরের উপাদানমুক্ত হওয়াও জরুরি। এছাড়া দেখতে বেশি চ্যাপ্টা ও লম্বা টুকরো যতোটা সম্ভব বাদ দিতে হবে।পানি সাধারণত মিউনিসিপ্যালিটি থেকে সরবরাহকৃত খাবার উপযোগী পানিই নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। এছাড়া ব্যবহৃত পানিতে তেল, অ্যাসিড, লবণ বা জৈব অপদ্রব্য আছে কি না, সেটিও আপনি নিজে পরখ করে দেখতে পারেন। সামুদ্রিক পানি বা মাটির গভীরের পানি নির্মাণকাজের জন্য একেবারেই উপযোগী নয়।